নাসের আবু খালেদ, কুয়েত প্রতিনিধি:
ফ্রেঞ্চ ভাষায় বললাম, দুই টাকার বাদাম দেন, উনি বাদাম দিচ্ছেন আর বললেন ভাতিজা কি বাঙালি? বললাম, হা চাচা বললেন! কতদিন থেকে ফ্রান্সে? বললাম, তিন বছর হওয়ার পথে। জিজ্ঞেস করলেন কাগজ পেয়েছি কি’ না? বললাম জ্বি দশ বছরের কাগজ পেয়েছি। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললেন, নয়টা বছর হয়ে গেলো,কাগজ পাইনি এখনো দেশে ও যেতে পারিনা।
বাদাম দেয়ার পর টাকা দিতে গেলাম, নিলেন না।
বললেন, কাজ না থাকলে চলো ভাতিজা গল্প করি?
বললাম, কাজ আছে তবে দেড় ঘন্টা পর।
জিজ্ঞেস করলেন, দেশের বাড়ি কোথায়? বিয়ে করছি কি’না, মা বাপ আছেন কি’না। একজন বয়স্ক মানুষ, আমাদের মতো ছেলের বয়সী কাউকে পেলে যা জিজ্ঞেস করেন এমন প্রশ্ন ছিল।
বেশ মোটা মানুষ তার উপর বয়স্ক, এরমধ্যে ইল্লিগ্যাল, বুঝলাম এই জন্য উনারে কেউ কাজে নেয় না।এইজন্যই ফুটপাতে বাদাম বিক্রি করছেন হয়তো।
পকেট থেকে স্যামসাং ফোন বের করে,স্ক্রিনে থাকা একটা মেয়ের ছবি দেখালেন কেমন মেয়েটা সুন্দরী কি’না?
একটা কিশোরী মেয়ের বাড়ন্ত বয়সে যে’রকম সুন্দরী থাকে ওরকমি। বেশ সুন্দর মেয়েটা।বললাম, হা অনেক সুন্দরী। বললাম, চাচা আমার জন্য মেয়ে সেটিং করতেছেন কি’না। আমি আপনাদের ঐ কুমিল্লায় গিয়ে বিয়ে করব না। বললেন, থাম বেটা থাম কাস্টমার বিদায় করি।সিগারেট খাইলে একটা ধরা।
সিগারেট ধরালাম, চাচায় কাস্টমার বিদায় করলেন।তারপর বললেন, এটা আমার মেয়ে। বলেই চাচায় মুচকী হাসি শুরু করলেন। ভারী মুচ আর লাল দাড়ী,রহস্যময় মুচকি হাসি। আমি সিওর চাচায় এবার বলবে,আমার মেয়েরে বিয়ে করবে?
চাচায় কথা বলে থামেন, মুচকি হাসেন, লংটাইম আবার বলেন। চাচা বললেন, আমার এই মেয়ে ক্লাস এইটে গোল্ডেন পেয়েছে। বললাম, চাচা গোল্ডেন কি।চাচা বললেন, এটা কি আর আমি জানি। আমি মুর্খ মানুষ। আমার মেয়েটা পড়ায় খুব ভালো।আমার দুই মেয়ে,এটাই বড়।
আমি রহস্য নিয়ে এগোচ্ছি, কবে চাচা বলে উঠেন,আমার মেয়েরে বিয়ে করবে?
বললাম, চাচা ডেইলি কেমন ইনকাম হয়। বললেন, মনে কর ত্রিশ পয়ত্রিশ,চল্লিশ এরকম। বললাম,অনেক কম।রুমভাড়া, থাকা খাওয়ার বিল দিলে’তো আর বাড়ীতে পঞ্চাশ হাজার ও দিতে পারবেন না। বললেন,টাইনাটুইনা মাসে পঞ্চাশ দেই তোমার চাচীর একাউন্টে।
বললেন, ভাতিজা সম্পদ করছি,নতুন আসার পর ভালো বেতনেই কাজ করছি।বাড়ি’তো আছেই।মেয়েদের নামে ডিপোজিট। আর মনে কর, কুৃমিল্লা শহরে বাসার জায়গা কিনছিলাম পচিশ লাখ দিয়ে,এখন পঞ্চাশ লাখ বিক্রি হবে।আল্লাহ এনাফ দিছেন ভাতিজা।বললাম,চাচা দেশে চলে যান।এই বয়সে আর বিদেশ।বললেন, আগামী বছর কার্ড পাবো তারপর যাবো।ফ্রান্সে নরমালি কেউ টানা দশবছর থাকলে,অটোমেটিক লিগ্যাল কার্ড দিয়ে দেয়।
যাইহোক,বললাম চাচা গিয়ে, গোসল খাওয়া তারপর কাজে যাওয়া, অন্য দিন কথা হবে। ছাড়লেন না,বললেন বিশ মিনিট দাড়াও গল্প করি, তোমার সাথে।না করতে পারলামনা।
বললেন,আমার এই মেয়ে মেট্রিকে এ প্লাস পেয়েছে। পড়ায় খুব ভালো।আমার তো মনে কর, আশা, মেয়েরে টাকা পয়সা খরছ কইরা পড়ামু,ডাক্তার বানামো,রুজি করার দরকার নাই।গরীব মানষের চিকিৎসা করলো।আমার তো আল্লাহ দিলে অনেক আছে,মেয়ে মনে কর,আমার টাকাই বাকি জীবন খরছ করলো।
আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলামনা,চাচা ঘুরেফিরে উনার মেয়ের গল্পেই আসেন কেন।বললেন,ভাতিজা আমি ফেসবুকে ভিডিও দেখলাম,এক ছেলে হেলিকপ্টারে বিয়ে করতেছে।মনে কর, আমি ও খবর নিয়া দেখলাম পাঁচ দশলাখ খরছ করলে হেলিকপ্টার চড়াইয়া আমার মেয়েরে ওর শশুড় বাড়ি পাঠাতে পারবো।বললাম চাচা,আপনার মেয়ে নিয়া’তো দেখি বিশাল স্বপ্ন।
বললেন,ভাতিজা আমাদের এই বয়সে এসে নিজের আর কিচ্ছু আশা আকাঙ্ক্ষার থাকেনা।সব স্বপ্ন থাকে বাচ্চা কাচ্চা নিয়া।বললেন, ভাতিজা মেয়ে মেট্রিক পাশ করার পর বললো,ফোন লাগবে,দিলাম। মাস ছয়েক পরে বলে, আলাদা একলা রুমে থাকবে, ওর পড়ার জন্য।
রুম তো ছিলই দিলাম। আমার মেয়ের একলা রুম ভিডিও কলে দেখি, শুধু খাট আর পড়ার টেবিল আর কিছু নাই।তোমার চাচীরে বলে, একসেট সোফা কিনে দিয়ে রুম একদম সুন্দর করে সাজিয়ে দিলাম।
মেয়ে খুব খুশি হয়েছিল সোফা কিনে দেয়ায়।এরমধ্যে মনে কর ভাতিজা অনেক বিয়ের প্রস্তাব আসা শুরু হলো,ভালো ভালো বিয়ের প্রস্তাব, ছেলে ব্যাবসায়ী,বিদেশে সেটেল্ড ,আরো কত’কি।মেয়ে রাজি না,সে পড়বে।আমি এবার পাক্কা সিওর হলাম, পরিশেষে চাচা বলবেন,তোমার মতো ছেলে পাইলে দিয়ে দিবো।
চাচা বললেন, এই বছর আমার মেয়ের আইএ (এইচএসসি) পরিক্ষা দিতো, দেশে করোনার জন্য পিছিয়ে গেলো।শুন ভাতিজা,একদিন রাতে স্বপ্নে দেখি আমার শরীর মাথা সব জায়গা থেকে আমার সব চুল পড়তেছে,। পড়ে একদম নাই হয়ে গেছে। আমি রাস্তা দিয়ে হাটলে,মানুষ আমাকে দেখলে হাসে।স্বপ্নটা দেখে ঘুম ভেঙ্গে গেলো, রাত বাজে চারটা, বাংলাদেশ টাইম সকাল আটটা।মনের মধ্যে কেমন অশান্তি করতেছে, আমার এই এক অভ্যাস খারাপ লাগলে,আমার মেয়ে দুইটার সাথে কথা বলি। কল দিলাম মেয়ের ফোনে, ও ফোন ধরেনা।ভাবলাম ঘুমে হবে।তোর চাচীর ফোনে ফোন দিলাম।
তোর চাচী চোখে কম দেখে চশমা ব্যাবহার করে।খুব একটা বুড়ী হয়নি, চোখে রোগ ওর, বলে হাঁসলেন চাচা।তোর চাচীরে কল দিলে,ও প্রথমে চশমা পরবো তারপর ফোন খোঁজে বের করবো,তারপর ফোন রিসিভ করবো।কানা মানুষ বুঝলী ভাতিজা, বলে চাচা হাসিতে ফেটে পড়লেন।
তো ফোন দিলাম তোর চাচীর ফোনে,ও ফোন রিসিভ করলো।সালাম কালাম হওয়ার পর জিজ্ঞেস করলাম, মেয়ে ফোন রিসিভ করেনি কেন? ও কই! তোর চাচী বললো ঘুমায়, হয়তো বলতে বলতে ওর রুমে গিয়া দেখে – ও ফাঁসিতে ঝুলছে।
চাচা তবুও হাসছেন,মুচকি হেসেই যাচ্ছেন আর বাদাম নাড়ছেন।বললাম, বলেন কি চাচা?বললেন, হ্যা ভাতিজা মেয়েটা মরার আজ সাইত্রিশ দিন চলছে।আমি মনে কর কার্ড পেলে, দেশে গিয়া, তোর চাচীরে নিয়া হজ্ব কইরা আইসা,মরার জন্য শুইয়া পড়মু।যতক্ষণ না মরছি আর কাঁদবোনা।আরে ব্যাটা,কার জন্য বাঁচবো কষ্ট করবো?
কত কষ্টের মেয়ে,কত আদরের মেয়েটা,কত স্বপ্নের মেয়ে আমার মরে গেলো কোন ছেলের জন্য।
বিলিভ মি- চাচা তবু ও হাসছিলেন! আমি পুরাই হ্যাং হয়ে গেছি কতক্ষণের জন্য। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বললাম, চাচা আসি আজ।আবার আসবো শিওর। ফোন নাম্বার দিয়ে বললাম, যখন ইচ্ছে কল দিয়েন,আসবো আপনার সাথে গল্প করতে।
মানুষ মনে হয় কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে হাঁসে অথবা,কান্নাকে অযৌক্তিক মনে করে বা ভয় পায়, কান্না করতে যদি নিজেকে হারিয়ে ফেলে, তখন ভালো থাকার অভিনয়ের জগৎ থেকে প্রবাসীরা সেরা অভিনয় শিল্পী এমন করে অজানা রয়ে যায় লক্ষ লক্ষ প্রবাসীর জীবনে অনেক কথা………..
Leave a Reply