✍ লেখক জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ানঃ
“যে জাতি তার অতীতকে বিস্মৃত হয়, তার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত ও অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।” ( ইবনে খালদুন)
সময়ের স্রোত কখনো থেমে থাকে না। দিন আসে, দিন যায়, কিন্তু কিছু দিন ইতিহাসের পাতায় এমন দাগ কেটে যায়, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী অমলিন থেকে যায়। ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ তেমনই এক দিন—এক শোকাবহ অধ্যায়, এক অপূর্ণতার নাম। এই দিনেই আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত হয় মুসলিম বিশ্বের চিরন্তন ঐক্যের প্রতীক উসমানীয় খেলাফত। এক সময় যে খেলাফত ইসলামের ধ্বজা উড়িয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী রাজত্ব করেছিল, জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছিল, ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল, তা কীভাবে নিঃশেষ হয়ে গেল? কোন ঘটনাপ্রবাহ এর পতনকে তরান্বিত করল? মুসলিম বিশ্বের এই দুর্দশার জন্য দায়ী কে? ইতিহাসের পরতে পরতে খুঁজলে পাওয়া যায় এর উত্তর। রাজকীয় প্রাসাদ থেকে যুদ্ধক্ষেত্র, কূটনৈতিক চুক্তি থেকে গোপন ষড়যন্ত্র—সবকিছু মিলিয়ে রচিত হয়েছে এক মহাকাব্যের করুণ সমাপ্তি।
★ উত্থান, রক্তে লেখা এক বিজয়ের ইতিহাস
১৩ শতকের সূর্য যখন অস্তাচলে, তখন আনাতোলিয়ার বুক চিরে উঠে আসছিল এক নতুন শক্তির আলো। একদল যোদ্ধার মাঝে স্বপ্ন জাগ্রত করলেন এক দুর্দান্ত নেতা—ওসমান গাজী। তলোয়ারের ধার, দৃঢ় বিশ্বাস ও অতুলনীয় বীরত্বের মাধ্যমে তিনি যে সাম্রাজ্যের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন, তা শতাব্দীর পর শতাব্দী ইসলামী সভ্যতার সূর্য হয়ে জ্বলজ্বল করবে। ১৪৫৩ সালে মেহমেদ ফাতিহ—ইতিহাসে যিনি মুহাম্মাদ বিজেতা নামে পরিচিত—কনস্টান্টিনোপলের অটল প্রাচীর ভেদ করে উসমানীয় বিজয়ের সোনালি যুগের সূচনা করলেন। রোমান সাম্রাজ্যের প্রাচীন রাজধানী পতিত হলো, ইস্তাম্বুল হয়ে উঠল নতুন ইসলামী বিশ্বের প্রাণকেন্দ্র। এরপরের শতাব্দীগুলোতে সুলতান সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্টের মতো শক্তিশালী শাসকরা উসমানীয় খেলাফতের শাসনব্যবস্থাকে এতটা সুসংহত করলেন যে তা ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার বিশাল অংশজুড়ে বিস্তৃত হলো। এই সাম্রাজ্য কেবল যুদ্ধজয়ের জন্য বিখ্যাত ছিল না, বরং বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, স্থাপত্য ও ন্যায়বিচারের জন্যও ইতিহাসে জায়গা করে নিল।
★ ধ্বংসের পূর্বাভাস, অন্তর্দ্বন্দ্ব, ষড়যন্ত্র ও পতনের সুর
শক্তির শিখর থেকে অবসানের দিকে পতনের পথ কখনো রাতারাতি গড়ে ওঠে না। ধীরে ধীরে, নীরব অথচ নিশ্চিত এক মৃত্যু এগিয়ে আসে। ইউরোপ যখন নতুন দিগন্তে পাড়ি জমাচ্ছিল, বিজ্ঞান, শিল্প ও প্রযুক্তির বিপ্লবে নিজেদের নতুন করে গড়ে নিচ্ছিল, তখন উসমানীয় সাম্রাজ্য আত্মতুষ্টির জালে আটকে পড়েছিল। একদিকে দুর্নীতি ও বিলাসিতা, অন্যদিকে প্রশাসনিক ব্যর্থতা—অযোগ্য শাসকদের হাতে ক্ষমতার সঞ্চার। সব মিলিয়ে এক অস্থির সময়। উসমানীয় দরবারের অভ্যন্তরে ষড়যন্ত্রের ছায়া ঘনিয়ে আসে। ১৭ ও ১৮ শতকে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো যখন তাদের আধিপত্য বিস্তারে মরিয়া, উসমানীয় খেলাফত তখন নিজেদের গৌরবময় অতীত আঁকড়ে ধরে রাখতে ব্যস্ত। যুদ্ধক্ষেত্রে একসময় যে সেনারা দুর্ধর্ষ বিজয়ী ছিল, তাদের অস্ত্র এখন মরিচা ধরেছে। যে প্রশাসন ছিল এক সময় অবিচল, তা এখন দুর্নীতিগ্রস্ত ও অকার্যকর হয়ে পড়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরাজয় এই দুর্বলতাকে চূড়ান্ত করে তোলে। ১৯২০ সালের সেভ্রেস চুক্তি উসমানীয় ভূখণ্ডকে টুকরো টুকরো করে ফেলে, যার পরিণতিতে সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব সংকট তৈরি হয়।
★চূড়ান্ত পরিণতি, যখন সূর্য অস্তমিত হয়
১৯২৩ সালে লউজান চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে উসমানীয় খেলাফতের ভবিষ্যৎ প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়। আরবি, তুর্কি, কুর্দি, ফারসি, বসনীয়সহ বহু ভাষা ও জাতির সম্মিলনে গড়ে ওঠা এই সাম্রাজ্য আর টিকে থাকেনি। অবশেষে ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ তুরস্কের নতুন নেতা মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক আনুষ্ঠানিকভাবে খেলাফত বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। একদিন যে খেলাফত মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক ছিল, তা পরিণত হয় শুধুই ইতিহাসের এক অধ্যায়ে।
★খেলাফতের পতন ও মুসলিম বিশ্বের প্রতিক্রিয়া
খেলাফতের বিলুপ্তি মুসলিম বিশ্বের জন্য এক গভীর ক্ষত হয়ে রইল। ভারতীয় উপমহাদেশে মোহাম্মদ আলী, শওকত আলী ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে খেলাফত আন্দোলন শুরু হয়। যদিও এটি শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি, তবে এটি উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে ওঠে। আরব বিশ্বে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীদের দখলদারিত্ব আরও সুসংহত হয়ে ওঠে। তুরস্কে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ইসলামী চেতনাকে ধীরে ধীরে সরিয়ে দেওয়া হয়।
★ ১০১ বছর পর, খেলাফতের স্মৃতি কি এখনও জীবন্ত?
আজ শতাব্দীরও বেশি সময় পরও খেলাফতের শূন্যতা অনুভূত হয়। মুসলিম বিশ্বে এখনো বিভক্তি ও দ্বন্দ্ব অব্যাহত রয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংঘাত ও পরাশক্তির আধিপত্য মুসলিম উম্মাহকে দুর্বল করে রেখেছে। অনেকে খেলাফতের পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন, তবে তা বাস্তবায়নের পথ আজও অনিশ্চিত। আজকের বিশ্বে শুধু অতীতের গৌরব ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখা যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস, জ্ঞান, ঐক্য ও উন্নতির পথ অনুসরণ করা।
★ ইতিহাসের শিক্ষা, নতুন দিগন্তের সন্ধানে
ইতিহাস বলে পতন অনিবার্য নয়, যদি শিক্ষা গ্রহণ করা যায়। শুধু খেলাফত নয়, মুসলিম উম্মাহর হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করতে হলে প্রয়োজন ঐক্য, শিক্ষা, ন্যায়বিচার ও সুশাসন। শক্তির অধিকার কেবল তাদেরই, যারা জ্ঞান অর্জন করে, নৈতিকতাকে আঁকড়ে ধরে এবং ঐক্যবদ্ধ থেকে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ে। একশত এক বছর পরও ইতিহাসের এই অধ্যায় আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—নেতৃত্ব, ঐক্য ও আত্মউন্নতির পথেই রয়েছে পুনরুত্থানের সম্ভাবনা।
লেখক,শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর
হোয়াটসঅ্যাপ ✆ +201503184718
ইমেইল, mdraiyan6790@gmail.com
Leave a Reply