এক সময় আসে, যখন পৃথিবীর সমস্ত কোলাহল স্তব্ধ হয়ে যায়। শব্দের দরজায় তালা পড়ে, ভিড়ের মধ্যেও আত্মা নিঃসঙ্গ হয়ে ওঠে। তখন এক নিস্তব্ধ আলো আমাদের সামনে দাঁড়ায়—আমরা তাকে ভয় পাই, পালিয়ে বেড়াই, অথচ সে-ই আমাদের সত্যের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়।
আল্লাহ বলেন,
“তারা কি নিজেদের ব্যাপারে চিন্তা করে না?”
(সূরা আর-রূম: ৮)
এই আয়াত কোনো সাধারণ জিজ্ঞাসা নয়; এটি হৃদয়ের দরজায় কড়া নাড়ার মতো, যেখানে মানুষকে বলা হচ্ছে—”তুমি কি নিজেকে জানো? তোমার আত্মার গভীরে যে অনন্ত রহস্য, তা কি একবারও উপলব্ধি করেছো?”
তোমার নিঃসঙ্গতা তোমার জন্য বোঝা হতে পারে, অথবা এটি হতে পারে তোমার মুক্তির সোপান—যেমনটি হয়েছিল নবীদের ক্ষেত্রে। ইব্রাহিম (আ.) একাকী দাঁড়িয়ে মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন, ইউসুফ (আ.) কারাগারের নিকষ কালো নিঃসঙ্গতা থেকে আল্লাহর ভালোবাসার শিখরে পৌঁছেছিলেন, মূসা (আ.) নির্জনে পাহাড়ে আল্লাহর সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন, আর রাসুল (সা.) হেরা গুহার নিস্তব্ধতা থেকে নবুয়তের আলো নিয়ে ফিরেছিলেন। তারা নিঃসঙ্গতা থেকে পালাননি; বরং তারা তাকে আত্মার পুনর্জন্মের পথ বানিয়েছিলেন।
আমরা মানুষ, ভুল করি, বিচ্যুত হই, কিন্তু আমরা কি কখনো নিজেকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করেছি? যে আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজের চেহারা প্রতিফলিত হয়, তার চেয়েও বেশি স্বচ্ছ একটি আয়না আছে—সেটি হলো মুহাসাবা (আত্মপর্যালোচনা)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
“বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি, যে নিজের আত্মার হিসাব গ্রহণ করে এবং মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের জন্য কাজ করে।”
(তিরমিজি)
কিন্তু আমরা কি নিজেদের হিসাব নেই? আমরা কি রাতের আঁধারে একবারও চিন্তা করি—
আজ আমি কি আল্লাহর জন্য কিছু করলাম?
আমার চোখ কি হারাম কিছু দেখেছে?
আমার হৃদয় কি অহংকারের আগুনে পুড়েছে?
এইসব প্রশ্নের সামনে দাঁড়ানো কঠিন, কারণ আমরা ভয় পাই। নিজের ভুলের মুখোমুখি হতে চাই না। তাই ব্যস্ততার আশ্রয়ে নিজেকে ভুলিয়ে রাখি। কিন্তু একদিন, যখন পৃথিবীর সমস্ত আলো নিভে যাবে, তখন আমাদের সামনে একমাত্র সত্য হবে—আমাদের আত্মার হিসাব।
সেদিন আল্লাহ বলবেন,
“পাঠ কর তুমি তোমার কিতাব। আজ তোমার হিসাব গ্রহণের জন্যে তুমিই যথেষ্ট।”
(সূরা আল-ইসরা: ১৪)
তুমি একদিন সেই কিতাব খুলবে—যেখানে তোমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত লিপিবদ্ধ থাকবে। সেই দিন যদি নিজের আত্মার সামনে দাঁড়ানো কঠিন হয়, তবে আজই মুহাসাবা শুরু করো।
আজকের মানুষ সবচেয়ে বেশি ভয় পায় একাকীত্বকে। রাত গভীর হলে সে মোবাইল স্ক্রিনের আলোয় মুখ লুকায়, নিজেকে ডুবিয়ে রাখে অপ্রয়োজনীয় কোলাহলে। অথচ এই একাকীত্ব যদি সে উপলব্ধি করত! যদি এই নিঃসঙ্গতা তাকে আল্লাহর কাছে ফিরিয়ে নিত!
ইমাম হাসান আল-বাসরি (রহ.) বলেছিলেন,
“তুমি যদি তোমার আত্মাকে সত্য দিয়ে ব্যস্ত না রাখো, তাহলে শয়তান তোমাকে মিথ্যা ও অকাজে ব্যস্ত করে ফেলবে।”
তুমি কি কখনো লক্ষ্য করেছো, কেন রাতের গভীরে একাকীত্ব বেশি অনুভূত হয়? কেন আত্মার শূন্যতা তখন আরও প্রকট হয়ে ওঠে? কারণ সেটিই সেই মুহূর্ত, যখন আল্লাহ তোমাকে ডাকেন—
“তুমি কি সত্যের সন্ধান করবে না? তুমি কি তোমার রবের দিকে ফিরে আসবে না?”
কিন্তু আমরা কি সেই ডাক শুনি? নাকি গান, ভিডিও, আড্ডা—এসব দিয়ে আত্মার সেই নিঃসঙ্গ চিৎকারকে ঢেকে ফেলি?
রাসুল (সা.) বলেছেন,
“সাত শ্রেণির মানুষ কিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ছায়া পাবে… তাদের মধ্যে একজন সেই ব্যক্তি, যে নির্জনে একাকী আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চোখের পানি ফেলে।”
(বুখারি)
এই কান্না দুর্বলতার নয়, বরং শক্তির প্রতীক। এই অশ্রু আমাদের অহংকারের দেয়াল ভেঙে ফেলে, আমাদের আত্মাকে শুদ্ধ করে। রাতের অন্ধকারে, যখন পৃথিবী ঘুমিয়ে থাকে, তখন যে চোখ আল্লাহর প্রেমে ভিজে যায়—সেই চোখই কিয়ামতের দিন আলো হবে।
প্রশ্ন করো নিজেকে। আত্মার সেই গভীর আয়নার সামনে দাঁড়াও।
নীরবতা থেকে শিক্ষা নাও। কথার ভিড়ে নয়, বরং নীরবতার মাঝে আত্মা সত্য উপলব্ধি করে।
আল্লাহর সঙ্গে সংযোগ গড়ো। একাকীত্বকে মোবাইল স্ক্রিনের বন্দীশালায় আটকে ফেলো না, বরং একে সিজদার স্থানে পরিণত করো।
একাকীত্ব হলো এক রহস্যময় দরজা। কেউ এটিকে শূন্যতা ভাবে, আবার কেউ এটিকে আল্লাহর ভালোবাসার দরজায় রূপান্তরিত করে। তুমি কোন পথ নেবে?
যদি তোমার জীবনে এমন একটি রাত আসে, যখন নিঃসঙ্গতার স্রোত তোমাকে ঘিরে ধরে, যখন মনে হবে তুমি একা, তখন মনে রেখো—
“তুমি আল্লাহকে ভালোবাসো, আর আল্লাহও তোমাকে ভালোবাসেন।”
তুমি একা নও।
তোমার রব তোমার অপেক্ষায় আছেন।
নিঃশব্দ রাতের প্রতিটি নিঃশ্বাসে যদি তুমি আল্লাহকে খুঁজে পাও, তাহলে তোমার নিঃসঙ্গতা হবে না কোনো অভিশাপ—বরং সেটিই হবে তোমার মুক্তির সূচনা।
✍️মুন্তাছির সিয়াম।
শিক্ষার্থী,
ডিপার্টমেন্ট: ‘ইসলামিক থিওলজি অ্যান্ড দাওয়াহ’ আল আজহার ইউনিভার্সিটি, কায়রো, মিশর।
Leave a Reply