✍️লেখক জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান:
ইসলামের দাওয়াত এক মহিমান্বিত আহ্বান, যা সীমান্তের দেয়াল পেরিয়ে মানুষের হৃদয়ে শান্তি, সম্প্রীতি ও একতার বাণী পৌঁছে দেয়। নবী করিম সা. ছিলেন মানবজাতির জন্য এক পরম দৃষ্টান্ত, যিনি দাওয়াতের মাধ্যমে অন্ধকার যুগের মানুষকে সত্যের আলোয় আলোকিত করেছেন। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় দাওয়াতের সেই পবিত্র সৌন্দর্য অনেক ক্ষেত্রেই কলুষিত হয়েছে। আজকের সমাজে আমরা দেখছি, দায়ীদের অনেকে ইসলামের শাশ্বত শিক্ষা প্রচারের পরিবর্তে নিজেদের মতবাদ, গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতেই অধিক ব্যস্ত। ফলে ইসলামের সার্বজনীন বার্তা হারিয়ে যাচ্ছে দলীয় বিভক্তির অতল গহ্বরে, উম্মাহর ঐক্য চূর্ণ-বিচূর্ণ হচ্ছে, আর ইসলামের সৌন্দর্য ঢাকা পড়ে যাচ্ছে ব্যক্তিস্বার্থের আবরণে।
★ ইসলামের দাওয়াত: এক বিশ্বজনীন আহ্বান
ইসলামের দাওয়াত কখনো কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা দলের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে সমগ্র মানবজাতির জন্য এক দিশারী আলো। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন:
“বল, এই আমার পথ—আমি ও আমার অনুসারীরা আল্লাহর দিকে আহ্বান করি পূর্ণজ্ঞানের ভিত্তিতে।” (সুরা ইউসুফ: ১০৮)
রাসুলুল্লাহ সা. তার দাওয়াতে কখনো কোনো দল বা মতবাদকে কেন্দ্র করে মানুষকে আহ্বান করেননি। বরং তিনি সর্বস্তরের মানুষের কাছে আল্লাহর বানী অকপটে পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি ছিলেন সকলের জন্য রহমতস্বরূপ, যার দাওয়াতে ছিল না দলীয় পক্ষপাত, ছিল না সংকীর্ণ গোষ্ঠীগত স্বার্থ। অথচ আজকের বাস্তবতায় আমরা লক্ষ্য করি, অনেক দায়ী ইসলামের মূল আকিদা ও শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করার পরিবর্তে নিজেদের নির্দিষ্ট দল বা সংগঠনের প্রচারে অধিক আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
★দলীয় প্রচারণার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা বিভাজন
আজকের সমাজে দায়ীদের অনেকেই ইসলামের পরিবর্তে নিজেদের মতবাদকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। কেউ বলছেন, তাদের দলই হকপন্থী, অন্যরা বিভ্রান্ত; আবার কেউ তাদের সংগঠনের বাইরে কাউকে সত্যের দাবিদার হিসেবেই মানতে নারাজ। এই সংকীর্ণ মানসিকতা ইসলামের ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে, মুসলমানদের মধ্যে বিভক্তির দেয়াল গড়ে তুলছে। এর ফলে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে—তারা বুঝতে পারছে না, কোনটি প্রকৃত ইসলাম, আর কোনটি দলীয় আদর্শের মোড়কে প্রচারিত ব্যক্তিস্বার্থ। এক গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীকে প্রত্যাখ্যান করছে, ফলে মুসলমানদের মধ্যে মতানৈক্য দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে।ইসলামের পরিচয়ের চেয়ে দলীয় পরিচয় বড় হয়ে উঠছে, যা উম্মাহর ঐক্যের জন্য ভয়াবহ হুমকি।
আল্লাহ তাআলা কুরআনে স্পষ্টভাবে বলেছেন:
“তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” (সুরা আলে ইমরান: ১০৩)
কিন্তু আজকের বাস্তবতায় দলীয় দাওয়াতের ফলে মুসলমানদের মধ্যে যে বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে, তা কেবল ইসলামের শিক্ষা থেকেই নয়, বরং উম্মাহর অস্তিত্বের জন্যও হুমকিস্বরূপ।
★ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ও ইসলামের নামে ব্র্যান্ডিং
সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে জনপ্রিয়তা যেন এক নতুন দাওয়াতের ধরণ হয়ে উঠেছে। দায়ীদের অনেকেই আল্লাহর সন্তুষ্টির চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন ফলোয়ার, লাইক ও শেয়ারের সংখ্যাকে। ওয়াজের মঞ্চ এখন অনেকের জন্য পরিণত হয়েছে আত্মপ্রচারের প্ল্যাটফর্মে। একে অপরের বিরুদ্ধে বিতর্ক সৃষ্টি করাই যেন দাওয়াতের প্রধান উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই জনপ্রিয়তা অর্জনের প্রতিযোগিতায় কিছু দায়ী এমনসব বক্তব্য দিচ্ছেন, যা ইসলামের মৌলিক শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক। অনেকে অন্য দল বা চিন্তাধারাকে আক্রমণ করেই ভাইরাল হওয়ার চেষ্টা করেন, অথচ ইসলামের প্রকৃত দাওয়াত কখনো কাউকে হেয় বা অপমান করার শিক্ষা দেয়নি।
★দাওয়াতের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী হওয়া উচিত
ইসলামের দাওয়াতের মূল উদ্দেশ্য হলো—মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করা, কোনো নির্দিষ্ট দল বা মতবাদে আবদ্ধ করা নয়। একজন প্রকৃত দায়ী হবেন সেই ব্যক্তি, যিনি শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দাওয়াত দিবেন: কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ বা দলীয় পরিচয়ের প্রচারে নয়।
বিভক্তির পরিবর্তে মুসলমানদের একত্রিত করার চেষ্টা করবেন। কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থে সত্যকে আড়াল করবেন না। যাতে মানুষ দাওয়াত গ্রহণে আগ্রহী হয়।
★উম্মাহর ঐক্য রক্ষায় আমাদের করণীয়
এই দলীয় দাওয়াতের বিপরীতে আমাদের প্রয়োজন ইসলামের সার্বজনীন দাওয়াতের দিকে ফিরে যাওয়া। একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের করণীয় কুরআন ও হাদিসের আলোকে সত্যতা নিশ্চিত করে, যে দাওয়াত শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, তা গ্রহণ করা। দুঃখের বিষয় হচ্ছে বর্তমানের অনেক দায়ী ইসলামের নামে দলীয় প্রচারণায় লিপ্ত, যা উম্মাহর ঐক্যের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা হলো—সকল বিভক্তির ঊর্ধ্বে উঠে আল্লাহর পথে মানুষকে আহ্বান করা। আমাদের প্রত্যেকের উচিত দলীয় দাওয়াতের পরিবর্তে বিশুদ্ধ ইসলামী জ্ঞান অন্বেষণ করা এবং উম্মাহর ঐক্য সংরক্ষণের জন্য একসাথে কাজ করা।
আল্লাহ তাআলা কুরআনে স্পষ্টভাবে বলেছেন:
“তোমরা ন্যায়ের পথে আহ্বানকারী, সৎ কাজের নির্দেশদাতা ও অসৎ কাজের প্রতিরোধকারী এক জাতি হও। তারাই সফলকাম।” (সুরা আলে ইমরান: ১০৪)
আসুন, দল নয়—ইসলামের প্রকৃত দাওয়াতকে প্রাধান্য দেই!
লেখক, শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর
Leave a Reply