সোহাগ কাজী, মাদারীপুর জেলা প্রতিনিধি:
ইতালি গিয়ে স্বপ্ন পূরণ করতে চেয়েছিলেন মো. সুজন ফরাজী। বৈধপথে এই সুযোগ না পেয়ে অবৈধপথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তিনি। কিন্তু তাঁর এই সিদ্ধান্তে পরিবারের অন্য সদস্যরা সম্মতি জানালেও একমাত্র ছেলেকে নিয়ে এই ঝুঁকি নিতে রাজি হয়নি বাবা মিরাজুল ইসলাম।
ছেলে এই নিয়ে তার বাবার সঙ্গে কয়েক দফা মতবিরোধও হয়। একপর্যায় ছেলে বাবাকে কোন কিছু না জানিয়ে দালালের সহযোগিতা নিয়ে চলে যায় লিবিয়া।
সম্প্রতি লিবিয়ায় নৌকাডুবিতে ২৩ লাশ উদ্ধারের ঘটনায় সুজন ফরাজীও একজন। এ নিয়ে জেলায় মৃত্যুর সংখ্যা ১১ জন।
সুজনের মৃত্যুর বিষয়টি মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) সকালে নিশ্চিত করেছেন তাঁর বাবা মিরাজুল ইসলাম। নিহত সুজন মাদারীপুর সদর উপজেলার ঘটমাঝি ইউনিয়নের পূর্ব ঘটমাঝি এলাকার বাসিন্দা।
নিহতের স্বজন ও এলাকাবাসী জানায়, দালালের প্রলোভনে পড়ে গত বছর নভেম্বর মাসের শেষের দিকে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে ঘরবাড়ি ত্যাগ করেন মাদারীপুরের সুজন ফরাজী। প্রথমে তিনি ঢাকা থেকে পৌঁছান দুবাই। দুবাই শহরে কয়েকদিন থেকে সেখান থেকে লিবিয়ায় যান সুজন। এরপর তাকে লিবিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বেনগাজিতে একটি বন্দিশালায় রাখা হয়। সেখান থেকে গত ২৪ জানুয়ারি লিবিয়ার উপকুল থেকে একটি ইঞ্জিন চালিত নৌকায় ইতালির উপকুলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন সুজনসহ অভিবাসনপ্রত্যাশিদের বহন করা নৌকাটি। কিন্তু ইতালি পৌঁছানোর আগেই নৌকাটি ডুবে যায়।
মঙ্গলবার বেলা ১২টার দিকে সরেজমিনে সুজনের বাড়ি পূর্ব ঘটমাঝি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, আশেপাশে মানুষের ভিড়। সবার মুখে সুজনের প্রসঙ্গ। বাড়ির সামনে একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে বুক চাপ্টে কান্না করছেন বাবা সিরাজুল। পাশেই তার খালারাও কান্না করছেন। প্রতিবেশিরা তাদের সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
জানতে চাইলে সুজনের বাবা মিরাজুল ইসলাম বলেন, এই বিদাশ বিদাশ কইরা তিন মাস ধরে বাবা-ছেলের রাগারাগি। বাড়ির লোক আমারে বলছে, সুজন ওর ফুফুর বাড়িতে আছে। তাই আমি দুশ্চিন্তায় ছিলাম না। পরে ২৫ জানুয়ারি আমি জানতে পারি, ফুফুদের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা লইয়া সুজন লিবিয়া গেছে। তখন থিকাই আমার মনে ভয়। আমার একমাত্র পোলা, আমি আগে জানলে ওরে কাইডা গাঙ্গে ভাসাইয়া দিতাম, তবুও অবৈধ পথে সাগর পাড়ি দিয়া বিদাশ যাইতে দিতাম না। পোলারে নিয়ে আমার সব স্বপ্ন শ্যাষ হইয়া গেলো।
সুজনের মা ২০০৩ সালে মারা যায়। এরপর থেকে সুজনের বাবাই তাকে লালন পালন করে বড় করেছেন। স্থানীয় একটি কলেজ থেকে সুজন উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে কয়েকদিন ইজিবাইকও চালিয়ে বাবাকে সহযোগিতা করেছেন।
মা মরা পোলাডার মায়ায়, পইরা ওর এক ফুফু টাকা দিয়ে ওরে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। এখন দুর্ঘটনায় সুজন মারা গেছে। এই জন্য যে দালাল ওরে এভাবে ঝুকি নিয়ে পাঠাইছে, আমরা তার বিচার চাই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লিবিয়া হয়ে ইতালি নেওয়ার দালাল মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার মজুমদারকান্দি এলাকার মো. হায়দার শেখের ছেলে মো. মনির শেখ। তিনি সুজনের থেকে ১৫ লাখ টাকায় ইতালি নেওয়ার চুক্তি হয়। এই সম্পর্কে দালাল মো. মনির শেখকে তার বাড়িতে গেলে ঘরটি তালাবদ্ধ দেখা যায়। মুঠোফোনেও একাধিকবার কল দিলেও নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
মনিরের প্রতিবেশি টুটুল মিয়া বলেন, মনিনের মাফিয়া সংযোগ খুবই শক্তিশালী। বহু যুবককে ইতালি পাঠানোর কাজ সফলভাবে করে বিশ্বাস অর্জন করেছে। এই কাজ করে বহু টাকাও উপার্জন করেছে। তবে মনির
সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনায় ওর নাম আসায় তিনি পলাতক। তাকে আমরাও কেউ খুজে পাচ্ছি না।
লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, লিবিয়া থেকে নৌযানে করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন একদল অভিবাসনপ্রত্যাশী। ৫৬ জন আরোহী নিয়ে নৌযানটি গত ২৫ জানুয়ারি ভূমধ্যসাগরে ডুবে যায়। এরপর ২৮ থেকে ৩১ জানুয়ারির মধ্যে ২৩টি মরদেহ সৈকতে ভেসে আসে। গলিত ওই মরদেহগুলোর পরিচয় নিশ্চিত না হওয়া গেলেও স্থানীয় সূত্রের বরাতে লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস বলছে, তাঁদের প্রায় সবাই বাংলাদেশি।
মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) ভাস্কর সাহা বলেন, লিবিয়াতে নিখোঁজ ও মারা যাওয়ার ঘটনায় প্রত্যেক পরিবারের সদস্যকে থানায় লিখিত অভিযোগ দিতে বলা হয়েছে।
তারা অভিযোগ দিলে পুলিশ মামলা গ্রহণ করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ ছাড়াও অভিযুক্ত কয়েকজন দালালের সন্ধানও আমরা পেয়েছি। তাদের ধরতেও পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
Leave a Reply