মোঃ শাহজাহান বাশার:
বর্তমান সমাজব্যবস্থায় যেকোনো অযাচিত আচরণের পেছনে যে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে, সেটি হলো ক্ষমতার অপব্যবহার। ব্যক্তি, গোষ্ঠী কিংবা প্রতিষ্ঠান—প্রত্যেক ক্ষেত্রেই যখন নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অপব্যবহার ঘটে, তখন তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে সমাজে জন্ম নেয় অনিয়ম, অনাচার ও বিশৃঙ্খলা। একটি সুসংগঠিত ও নৈতিক সমাজ গঠনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ক্ষমতার অবৈধ প্রয়োগ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ের ক্ষমতাসীন নেতাকর্মী কিংবা প্রভাবশালী ব্যক্তিরা যখন ক্ষমতার সীমা লঙ্ঘন করেন, তখন সমাজে একধরনের ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়। এতে সাধারণ মানুষ দুর্বিষহ অবস্থার মুখোমুখি হয় এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি আরও গভীর হয়। ক্ষমতার অপব্যবহারে অনেক সময় দেখা যায়—নিরপরাধ মানুষ হয়রানির শিকার হন, দুর্নীতিবাজেরা পুরস্কৃত হন, এবং অপরাধীরা আইনের আওতার বাইরে থেকে যান।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ক্ষমতার অপব্যবহার শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়; প্রশাসনিক কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও এর ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়ছে। শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীদের উপর মানসিক বা শারীরিক নির্যাতন, পুলিশ সদস্যদের দ্বারা সাধারণ মানুষকে বিনা অপরাধে আটক ও নির্যাতন, কিংবা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা জমি দখল বা অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের ঘটনাগুলো সবই এই অপব্যবহারের বাস্তব উদাহরণ।
অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, কোনো রাষ্ট্রের উন্নতির জন্য ন্যায্যতা, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা অপরিহার্য। কিন্তু যেখানে ক্ষমতাকে জবাবদিহিতার বাইরে রাখা হয়, সেখানেই গড়ে ওঠে ‘দায়িত্বহীন শাসনব্যবস্থা’। এতে করে প্রশাসনিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে এবং জনগণের আস্থা ভেঙে যায়।
অভিজ্ঞজনেরা আরও বলছেন, অযাচিত আচরণ ও ক্ষমতার অপব্যবহার একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। যখন কাউকে জবাবদিহির আওতায় আনা হয় না, তখন সে অনায়াসে নিজ ইচ্ছামতো আইন ও নীতিমালা ভঙ্গ করে। এতে করে গড়ে ওঠে একপ্রকার অনৈতিক সংস্কৃতি—যেখানে ভালো কাজ নয়, বরং ক্ষমতার জোরই হয়ে ওঠে সাফল্যের প্রধান হাতিয়ার।
এই প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞরা জোর দিচ্ছেন শক্তিশালী জবাবদিহির কাঠামো তৈরির ওপর। প্রতিটি ক্ষমতার অবস্থানেই যেন একটি কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা থাকে, তা নিশ্চিত করা জরুরি। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ, রাজনৈতিক দলগুলোর নৈতিক শিক্ষায় উদ্বুদ্ধকরণ, এবং সর্বোপরি, গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের নজরদারি বাড়ানোর মাধ্যমেই সম্ভব একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন।
সর্বোপরি বলা যায়, ক্ষমতা তখনই সমাজের কল্যাণে আসে, যখন তা ব্যবহার হয় স্বচ্ছতা ও নৈতিকতার সঙ্গে। কিন্তু যখন তা অপব্যবহৃত হয়, তখনই জন্ম নেয় অন্যায়, দুর্নীতি ও দমন-পীড়ন। ফলে রাষ্ট্রের শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয় এবং সাধারণ জনগণ অসহায় বোধ করে।
Leave a Reply