মোঃ শাহজাহান বাশার, ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি:
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির জাতীয়তাবাদী শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নে চলমান নেতৃত্ব সংকট এবং স্বঘোষিত সভাপতি হিসেবে পরিচিত অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী খন্দকার জুলফিকার মতিনের একক আধিপত্য ও বিতর্কিত কার্যকলাপকে ঘিরে পরিস্থিতি চরম উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। টানা চারদিন ধরে শ্রমিকদের বিক্ষোভ, সিবিএ অফিসে তালা এবং কর্তৃপক্ষের নীরবতা—সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানজুড়ে অস্থিরতা, ক্ষোভ ও বিভ্রান্তি বিরাজ করছে।
অবসরপ্রাপ্ত হয়েও সভাপতির দাবি, ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ
প্রায় দুই বছর আগে চাকরি থেকে অবসরে যাওয়া সত্ত্বেও খন্দকার জুলফিকার মতিন এখনও নিজেকে সিবিএ সভাপতি হিসেবে পরিচয় দিয়ে ইউনিয়নের সকল কার্যক্রমে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি তার পূর্বের পদ-পদবির অপব্যবহার করে বাইরের লোকদের মাধ্যমে তদবির, শিল্প সংযোগের নামে অনৈতিক সুবিধা আদায়, অবৈধ গ্যাস সংযোগ, এবং আউটসোর্সিংয়ের নামে দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন।
এছাড়াও, জুলফিকার মতিন তার অনুসারীদের ব্যবহার করে অফিসের ভেতরে ভয়ভীতি, গালিগালাজ এবং কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তার অনুগত হিসেবে পরিচিত সাতজন কর্মকর্তা ও কর্মচারী প্রায়ই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে দপ্তরের পরিবেশ নষ্ট করছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন—সিনিয়র সুপারভাইজার মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, সিনিয়র অফিস সহকারী মো. আলমগীর, সিনিয়র ইলেকট্রিশিয়ান মো. আনোয়ার হোসেন, গাড়িচালক মো. ইয়াসিন আলী, মো. ছাইফুল ইসলাম, পিসি অপারেটর মো. রাসেল আহমেদ এবং গাড়িচালক মো. লিটন শিকদার।
অফিসে তালা, শ্রমিকদের লাগাতার আন্দোলন ,৮ মে থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সংগঠনের অন্য পক্ষের নেতা ফয়েজ আহমেদ লিটন ও আব্দুল জব্বার। তাঁরা দাবি করেছেন, জুলফিকার মতিন আর কোনোভাবেই সংগঠনের প্রতিনিধি হতে পারেন না, কারণ তিনি অবসরপ্রাপ্ত। তার একচেটিয়া কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কর্মীরা সংহত হয়ে সিবিএ অফিস তালাবদ্ধ করেছেন এবং বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছেন।
১৩ মে সকালে কাওরান বাজারস্থ প্রধান কার্যালয়ের সামনে শতাধিক শ্রমিক একত্রিত হয়ে জোরালো স্লোগানে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। “স্বৈরাচারী মতিনের পতন চাই”—এই দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো অফিস চত্বর। এতে কর্মীদের ক্ষোভ ও হতাশা দৃশ্যমানভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
নারী কর্মকর্তার ওপর হুমকি, পরিবেশ আরও উত্তপ্ত ,১২ মে সোমবার ঘটেছে আরও একটি নিন্দনীয় ঘটনা। তিতাস গ্যাসের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) সৈয়দা আতিয়া বিলকিসের কক্ষে গিয়ে জুলফিকার মতিন ও নুরুল ইসলাম নাসিমসহ কয়েকজন কর্মকর্তা তার পারিবারিক তথ্য উল্লেখ করে ভয়ভীতি দেখান, হুমকি প্রদান করেন এবং অপমানজনক আচরণ করেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি শুধু দায়িত্বপালনকারী একজন নারী কর্মকর্তার জন্য অপমানজনক নয়, বরং এটি একটি গুরুতর অপরাধ এবং প্রশাসনিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি রাখে।
নির্বাচিত কমিটির অভাব ও প্রশাসনের অবস্থান ,তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বর্তমানে নির্বাচিত কোনো সিবিএ কমিটি নেই। প্রশাসনিক কারণে ইউনিয়ন রুমের চাবি কর্মকর্তাদের হেফাজতে রাখা হয়েছে এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধি ছাড়া কেউ সংগঠনের দাফতরিক কাজ পরিচালনা করতে পারবে না। প্রতিষ্ঠানটির একাধিক কর্মকর্তা মনে করছেন, নেতৃত্বের সংকট ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে তিতাস গ্যাসের স্বচ্ছতা ও কর্মপরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তদন্ত চলছে, বক্তব্য দিতে নারাজ মতিন ,বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, খন্দকার জুলফিকার মতিনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত একাধিক অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তবে একাধিকবার ফোন করা হলেও মতিনের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
আন্দোলনরত কর্মীরা স্পষ্টভাবে বলছেন, তিতাস গ্যাস একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, যেখানে দলীয় রাজনীতি কিংবা অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কর্তৃত্ব চলতে পারে না। দ্রুত একটি স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য ও নির্বাচনভিত্তিক কমিটি গঠন করে শ্রমিক ও প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে।
তিতাস গ্যাসে চলমান এই নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব শুধু একটি সংগঠনের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়, বরং জাতীয় সম্পদ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানটির স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও জনসেবা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। শ্রমিকদের যুক্তিসঙ্গত দাবি ও প্রতিষ্ঠান রক্ষায় সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জরুরি হস্তক্ষেপ এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
Leave a Reply