সাহেদ আলী,সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি:
সিরাজগঞ্জের সলঙ্গাবাসীর জন্য এপ্রিল শোকের মাস। বেদনাবিধুর ২৫ এপ্রিল সলঙ্গা গণহত্যা দিবস।প্রতি বছর এপ্রিল মাস এলেই সলঙ্গবাাসীকে মনে করে দেয় ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল এই দিনের নির্মম হত্যাকান্ড।অস্ত্রে সজ্জিত বর্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী অতর্কিত হামলা চালিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে ২ শতাধীক মুক্তিকামী ও নিরীহ মানুষকে হত্যা করে।উল্লাপাড়া উপজেলার বর্তমান সলঙ্গা থানার চড়িয়া মধ্যপাড়া,পাটধারী,কালিবাড়ী,শিকার মগড়াপাড়া,চড়িয়া শিকার দক্ষিনপাড়া, গোলকপুর,কাচিয়ার চরে সংঘটিত হয়েছিল এ গণহত্যাযজ্ঞ।সিরাজগঞ্জের সর্ববৃহৎ এ গণহত্যায় প্রায় ২ শ’ জন শহীদের আত্মদানের মধ্য দিয়ে রচিত হয় একটি শোকাবহ কালো দিবস।১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল পাবনা জেলার কাশিনাথপুর ডাব বাগান নামক হানাদার পাকিস্তানী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সন্মুখ যুদ্ধে অর্ধ শতাধীক পাক হানাদার নিহত হয়।এ ঘটনার প্রতিশোধ নিতে পাক হানাদার বাহিনী ২৫ এপ্রিল সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট হতে কাশিনাথপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। পথিমধ্যে বগুড়া- নগরবাড়ি মহাসড়কের সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল রোড গোল চত্বরের অনতিদুরে চড়িয়া শিকার নামক স্থানে রাস্তায় ব্যারিকেডের সন্মুখীন হয়ে যাত্রা বিরতি করে।তারা সন্ধান পায় চড়িয়া শিকার পুর্ব দক্ষিন পাশে অন্য একটি কাশিনাথপুর গ্রামের।হানাদার বাহিনী এই গ্রামকেই পাবনা জেলার সেই কাশিনাথপুর গ্রাম মনে করে পাক বাহিনী খুঁজতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি। তাদের এ দেশীয় দোশর রাজাকার,আলবদরদের সহযোগীতায় পাক বাহিনী সন্ধান লাভ করে চড়িয়া মধ্যপাড়ায় ডা: শাজাহান আলী, ইয়াকুব হোসেন,মোহাম্মদ আলীসহ অন্যদের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ঘাঁটি।এই ঘাঁটি তছনছ করে দিতে শুরু হয় পাক বাহিনীর নির্মম গণহত্যা।তারা চড়িয়া শিকারসহ আশেপাশের ৩/৪ টি গ্রামের প্রায় আড়াই শত জন মুক্তিপাগল মানুষকে আটকের পর আব্দুল মজিদের পুকুরের পাশে,ইয়ার আলীর পুকুরের পাড়ে দুই লাইনে সারিবদ্ধ করে হত্যা করে।এ গণহত্যায় ঘটনাস্থলেই প্রায় শতাধীক লোক শহীদ হন।হায়েনাদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া চড়িয়া মধ্যপাড়া গ্রামের আবুল কালাম (কাঙ্গাল মন্ডল) জানায়,তারা সুর্যোদয়ের পুর্ব হতেই নিরীহদের উপর নির্মম গুলি চালাতে থাকে।ভস্মিভুত করে এলাকার ঘরবাড়ি।পশুত্বের হাত থেকে রেহাই পায়নি কোলের শিশুও।এ গণহত্যায় শহীদদের মধ্যে ৬৩ জনের নাম পরিচয় পাওয়া যায়।তারা হলেন,চড়িয়া মধ্যপাড়া গ্রামের ডা: শাজাহান আলী, ইয়াকুব হোসেন, খলিলুর রহমান, হায়দার আলী,বাহাজ আলী,মেছের আলী, আবু বক্কার,মাহাম আলী,আজিজুল হক, আদম আলী,ইউসুফ আলী,গগন মন্ডল, ছলিম উদ্দিন, ছানোয়ার হোসেন, আবেদ আলী,আবু তাহের,আব্দুল মজিদ, দারোগ আলী,আবু তারা,আ: সামাদ মাস্টার,মজিবর রহমান,আসান আলী, শাহজাহান মন্ডল, কাইয়ুম,আব্দুল কাফি,তোমছের আলী,আ: মজিদ,আবু তালেব,কালু মিয়া, ফজলুর রহমান ফজল।কালিবাড়ি চড়িয়া গ্রামের সুজাবত আলী, হাবিবুর রহমান, আব্দুর রহমান,ছোরহাব আলী,আসগর আলী, গুটু সরকার,মুকুল সরকার,গোলকপুর গ্রামের আবু বক্কার সিদ্দিক,আব্বাস আলী মৃধা,কদম আলী,পাটধারি গ্রামের গোলাম হোসেন খন্দকার,আকদুর আলী খন্দকার,আব্দুর রাজ্জাক খন্দকার, আলকাফ হোসেন খন্দকার,জয়নুল আবেদীন খন্দকার, ময়দার ফকির, আমজাদ হোসেন তালুকদার,বাসু প্রামানিক,আব্দুস সামাদ আকন্দ, আব্দুর রশিদ আকন্দ,মোজদার আকন্দ,তাজু আক্ন্দ,মাহাতাব তালুকদার, খয়রুজ্জামান তালুকদার, আ:কাদের তালুকদার,জোনাব মন্ডল,মুকুল চৌধুরী, ফনি মীর, ননী মীর,তোমেজ খন্দকার ও নুরু মিস্ত্রী।এভাবেই আশেপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের প্রায় ২’শত নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে তারা হত্যা করে।সেদিনের ঘটনায় নামে ও বেনামে আরও কয়েকশ মানুষ আহত হন।দিনগুলো মনে হলে আজও বুক থর থর করে কেঁপে উঠে।
সিরাজগঞ্জ জেলার ১৮/২০ কি:মি পশ্চিমে উল্লাপাড়া উপজেলারই একটি মণোমুদ্ধকর গ্রাম চড়িয়ায় ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল ঘটেছিল নির্মম সেই ঘটনা।মনে পড়ে সেই বুক ফাড়া আর্তনাদ, চিৎকার বাঁচাও- বাঁচাও,আবার কখনও শোনা যেত একটু পানি দাও।প্রতিটি পরিবারে উপার্জনোক্ষম ব্যক্তি বাবা,ভাই অথবা স্বামী,কেউ না কেউ তখন এই গনহত্যার নির্মম শিকার হন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিশেষ করে চড়িয়া গ্রাম বিধবা গ্রাম হিসেবে বলতেও শোনা যেত।আজও সেই ভয়াল ২৫ এপ্রিল সলঙ্গা গণহত্যা দিবস পালিত হয়।যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালন উপলক্ষ্যে শহীদ স্মৃতি পরিষদ ও চড়িয়া জনকল্যাণ সমিতি বিভিন্ন কর্মসুচী গ্রহন করেছেন বলে জানানো হয়েছে।
Leave a Reply